প্রণয়ো_সন্ধি
সিওদা_ছোয়া
--তোমাকে আমার কথা মতোই বিয়ে করতে হবে তন্দ্রা। আমি যা বলবো তাই শেষ কথা।নয়তো এবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে পারো।
বাবার এই টুকু কথাই আমার মনটা যেনো একদম বিষিয়ে উঠলো। আর অর্পিতা মার বিশ্রি হাসি টা দেখে এই মুহূর্তে সব ভাংচুর করে চলে যেতে ইচ্ছে করলো। ছোট থেকেই অর্পিতা মা অর্থাৎ আমার সৎ মা আমার সাথে এরোকম করেন।পরীক্ষায় এ+ লাগবে নয়তো বাড়ি ছাড়তে হবে এই রকম সিদ্ধান্ত আমার ওপর চাপিয়ে দাওয়া হতো।বাড়ির সব কাজ আমাকে দিয়ে করান।আর বাবা কে মিথ্যা বলে বেরান।আর আমার বাবা তো বাবা ই। বাবার একটাই কথা অর্পিতা মার সব কথা আমাকে শুনতে হবে নয়তো এবারি ছাড়তে হবে।উঠতে, বাসতে আমাকে বাড়ি ছাড়ার হুমকি দেওয়া হতো সব সময়। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না।কোথা থেকে যেনো কোন ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক করালেন অর্পিতা মা তাও আবার টাকার লোভে। এটা বিয়ে তো নয় ই বরং আমাকে বিয়ে নামে বিক্রি করা হচ্ছে। এটা দেখে শুনেও বাবা কিচ্ছুটে বলছেন না ওলটো আমাকে বাড়ি ছাড়ার হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। এটা শুনে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না আমি। দৌড়ে নিজের রুমে চলে আসলাম।রুমে আসতেই দরজাট ছিটকিনি লাগিয়ে খাটে শুয়ে জোড়ে জোড়ে কাঁদতে লাগলাম। আর ভাবতে লাগলাম সেই পুরোনো স্মৃতি গুলো।
মা বাবার একমাত্র মেয়ে ছিলাম আমি। আমি নাকি ছোট বেলায় সারাদিনভর ঘুৃমাতাম আর নাকি রাতে ডাগর ডাগর চোখ করে তাকিয়ে থাকতাম।সেইজন্য নাকি মা সখ করে আমার নাম রেখেছিলেন তন্দ্রিতা তন্দ্রা। তারপর থেকে সবাই আমাকে তন্দ্রা বলেই ডাকে।মা-বাবা মিলে সুখের পরিবার ছিলো আমাদের। সুখের কোন কমতি ছিল না। বাবা তখন আমাকে চোখে হারাতেন।আমাকে ছারা কিচ্ছুটে বুঝতেন না। বাড়িতে আসলেই আমাকে কুলে তুলে নিতেন।কিন্তু কথায় আছে না অতি সুখ কখনো বেশিদিন কপালে থাকে না? আর সেটাই হলো আমার কপালে। হঠাৎ আমার মা ব্রেইন স্ট্রোক করে মারা যান। তখন আমার আট বছর ছিলো।আর সেদিন থেকেই আমার কপালে দুঃখ গুলো যেনো আগমনি বার্তা নিয়ে হাজির হলো।
মা মরে যাওয়ার কদিন পরই বাবা আরেকটা বিয়ে করেন তাও আবার আমাকে সামলানোর জন্য। কথাটা ভাবলেই বুকছিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। আর তখন থেকেই বাবা বদলাতে লাগলেন।অর্পিতা মা সারাক্ষণ ওইটুকু বয়সেই আমাকে দিয়ে সব কাজ করাতেন।একটু বড় হওয়ার পর আমাকে দিয়ে রান্না সহ বাড়ির যাবতীয় সব কাজ করাতেন।যতো বড় হতে লাগলাম বাবা ঠিক ততোটাই পরিবর্তন হতে লাগলেন।আমাকে আর আদর করতেন না। আর অর্পিতা মা তো আমাকে ঠিকমতো দু বেলা ভাত ও খেতে দিতেন না। আর বাবাকে বলতেন আমি নাকি ইচ্ছে করে খাই না আর ওনাকে নাকি যা মন চায় তাই বলে অপমান করে দিই।এটা শুনে বাবা সেদিন প্রথম বারের মতো আমার গায়ে হাত তুলেছিলেন।সেদিন সেকি কান্না ছিলো আমার আর অর্পিতা মা সেদিন আমাকে একটু ধরতে ও আসেন নি।
এভাবে দিন গড়াতে লাগলো আর আমার বাবা টাও ভিষন পর হতে লাগলো। কিছু থেকে কিছু হলেই অর্পিতা মা বাবাকে ভুল ভাল বুঝাতেন আর বাবা এসে আমাকে বাড়ি ছাড়ার হুমকি দিতেন।আর আমি মলিন চোখে সবটা দেখতাম কিন্তু আজ যে সহ্যের মাত্রা অতিক্রম করে ফেললেন অর্পিতা মা।আমাকে কটা টাকার লোভে একটা অচেনা ছেলের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেছেন।আর বাবা টাও কেমন করে সবটা যেনে শুনে মত দিলেন! খুব কষ্ট হচ্ছে আমার।বুকের ভেতরটা জ্বালাপুরা করছে আমার।কাল ই নাকি সেই ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে।এসব ভাবছি আর চোখের জল ফেলছি।এভাবে কাঁদতে কাঁদতে কখন যেনো ঘুমিয়ে পড়লাম খেয়াল নেই আর।
সকালে পাখির ডাকে ঘুম ভেঙে গেলো আমার। কোনমতো হেলে দুলে হেটে সিঁড়ি ঘাটলায় এসে বসলাম আমি। পুকুরের পানির দিকে নিজের প্রতিবিম্ভের দিকে তাকিয়ে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। এই বিয়ে করবো আমি দেখি আমার এই দুঃখ ভরা জীবন আমাকে কোন প্রান্ত অবদি নিয়ে যায়। ভেবেছিলাম পালাবো।কিন্তু কোথায় পালাবো! কোথাও যাওয়ার মতো যায়গা যে আমার নেই!
এসব ভেবে আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস নিলাম।
তারপর উঠে ফ্রেশ হয়ে ঘরের সব কাজ করতে লাগলাম। এভাবেই সারাদিন কেটে গেলো।সন্ধ্যায় আমার সৎ বোন সুসমিতা আমাকে একটা লাল বেনারসি ধরিয়ে দিয়ে বললো,
--এই নে তোর সারি। বর লোক বেটার বউ হতে চলেছিস।এই দেখ কতো দামি সারি আর গয়না গাটি দিয়েছে। এসব পরে তৈরি হয়ে নে। বর পক্ষ রওনা দিয়েছে।একটু পরই কাজি সাহেব আসবে। তাড়াতাড়ি চটপট তৈরী হো।অবশেষে বাড়ি থেকে বিদায় হচ্ছিস
বলেই মুখটা ঝামটা মেরে চলে গেলো।
আর আমি একবার বেনারসির দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তৈরি হতে লাগলাম।
একটু পর শুনলাম বর পক্ষ চলে এসেছে। আমাদের বাড়িটাও মুটামুটি সাজানো হয়েছে। তারপর অর্পিতা মা এসে আমাকে নিয়ে আমার হবু বরের সামনে আমাকে বসালেন।রাগে দুঃখে আমি আমার বরের মুখটা অবদি দেখলাম না।একটু পরই কাজি সাহেব আমাকে কবুল বলতে বললেন। তারপর আমি চোখ বন্ধ করে কবুল বলে দিলাম। ব্যাস হয়ে গেলো আমার বিয়ে।
বিদায়ের সময় অর্পিতা মায়ের সেকি ভুবন ভুলানো কান্না! যেনো আমি তার আপন গর্ভে ধারণ করা মেয়ে।এসব অভিনয়ে আমি অব্যস্থ। তাই আমার চোখ দিয়ে এক ফোটা অবদিও জল গড়ায় নি।আমি শক্ত কাঠের ন্যায় গাড়িতে উঠে বসে পরলাম। তারপর বাড়ির দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম,
--আর কখনো ফিরবো নারে তোর পাড়ায়!
বলেই বাবার দিকে তাকিয়ে চোখের কোটরে আটকো থাকা দু ফোটা জল ছেড়ে দিলাম।
অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে শশুর বাড়ি এসে পৌঁছালাম।বিশাল এক দালান বাড়ি। আশে পাশে মানুষ জনের অভাব নেই।সবাই হই হুল্লোড় করতে ব্যস্ত। তারপর আমি গৃহ প্রবেশ করলাম। তারপর সবাই মিলে আমাকে একটা ফুলে ভরা রুমে এসে বসালেন।তার কিছুক্ষণ পর কথা বলে আবার৷ সবাই চলে গেলেনরাত প্রায় ১টা ছুই ছুই।ঠিক তখন আমার বর রুমে প্রবেশ করলেন। এতোক্ষন পর আমি এই প্রথম আমার বর কে দেখে অবাকের শেষ প্রান্তে এসে ঠেকলাম। ওনি তো আমার কলেজের শিক্ষক, তুর্ন স্যার!যিনি সব সময় আমার ভালো মন্দের খবর নিতেন।আমি অবাক হয়ে ওনাকে দেখতে লাগলাম। ওনি আসতে আসতে আমার সামনে এসে দাড়িয়ে আমাকে বসতে বললেন। আমি অবাক হয়েই বসলাম।তারপর ওনি বললেন,
--আমি জানি তুমি আমাকে দেখে অনেক অবাক হচ্ছো। আর তোমার মনে অনেক কৌতুহল জন্মাচ্ছে। দেখো আমি সম্পর্কে তোমার মায়ের বান্ধবীর ছেলে হই। তোমার জীবনে ঘটে যাওয়া সব কিছুই আমি জানি।সেই ছোট বেলায় আমি তোমার মা কে বলেছিলাম যে আমি তোমার সব সময় খেয়াল রাখবো।আর আমি আমার কথা রেখেছি।তোমাকে তোমার বাড়ির জেলখানা থেকে তোমাকে মুক্ত করে আমার করে এনেছি।
এইটুকু বলে থামলেন ওনি। তারপর ওনি আমার দিকে তাকিয়ে আবারো বললেন,
--তুমি ভয় পেয়ো না আমি তুমার অনুমতি ব্যতিত তোমাকে ছুঁবো না।ঐ সুটকেসে তোমার যাবতীয় সব রকমের প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র আছে।যাও ফ্রেশ হয়ে আসো।
এই টুকু বলে ওনি সোফায় শুয়ে পরলেন।আর আমি থম মেরে বসে রইলাম।তারপর আসতে আসতে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পরলাম।
দৈনন্দিনের মতোই সকাল সকাল আমার ঘুম ভেঙে গেলো। ওঠে দেখি স্যার ঘুমাচ্ছেন।কি নিষ্পাপ দেখাচ্ছে ওনাকে।ওনার শুভ্র মুখ খানা দেখে আমার মনটা কেমন করে উঠলো। আচ্ছা ওনার সাথে আমার বিয়ের পবিত্র বন্ধনের জন্যই কি এরোকম অনুভূতি হচ্ছে আমার!!
তারপর নিজেই নিজেকে বললাম,
--ধুর কিসব ভাবছি আমি।
তারপর আমি ওঠে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম।
একটা লম্বা শাওয়ার নিয়ে এসে দেখি স্যার ওঠে পেপার প্রছেন আর কফি খাচ্ছেন।আমার উপস্থিতি টের পেতেই ওনি আমার দিকে তাকালেন।তারপর ওনি মুগ্ধ নয়নে আমার দিকে একমনে তাকিয়ে আছেন।ওনার চাহনি দেখো আমি ইশৎ কেঁপে উঠলাম।তারপর ওনি আসতে করে আমার সামনে এসে আমার খোপা থেকে টাওয়াল টা খুলে ফেললেন তারপর বলে উঠলেন,
--এবার ঠিকাছে একেবারে বউ বউ লাগছে।
বলেই হেসে আমার কফি খাওয়ায় মনোযোগ দিলেন।আর আমি হতবিহ্বল হয়ে ওনাকে দেখতে লাগলাম।
তারপর আসতে আসতে নিচে চলে গেলাম।তারপর সবার সাথে টুকিটাকি কথা বললাম।আমার শাশুড়ী অনেকটাই মিশুক। আর শশুর বাবা তো আমাকে মা ছাড়া কথাই বলেন না। ওনাদের কে পেয়ে মনে হলো আমি যেনো নতুন জীবনে একটা নতুন পরিবার পেলাম।হ্যা আমারি পরিবার এটা!মনে মনে অনেক দিন পর শান্তি অনুভব করলাম। আমার একটা পিচ্চি ননদ আছে। আমাকে আপুই বলে ডাকে। মনে হলো যেনো আমি আমার একটা ছোট্ট মিষ্টি বোন পেলাম।
আর ওনিও আমার সাথে যথেষ্ট বন্ধু সূলভ আচরণ করেন।আমাকে জীবনের সব পরিস্থিতির জন্য অনুপ্রাণিত করেন। আমাকে মনে সাহস জুগিয়ে দেন।আমার যথেষ্ট খেয়াল রাখেন।কখন আমার কি কি লাগবে সব এনে হাজির রাখেন।ওনার প্রতি আমার মনের অনেকটাই জড়তা কেটে গেছে। আমিও এখন দিন শেষে ওনার ফেরার অপেক্ষায় থাকি। এখন এই পরিবার টা পেয়ে নিজের ভাগ্যকে এখন আর দোষারোপ করতে পারি না।এভাবেই আমার জীবনের একেকটা সুন্দর, মিষ্টি প্রহর কাটছে।ইদানীং ওনার প্রতিও কেমন একটা অনুভূতি অনুভব হয় আমার। ওনাকে না দেখলে একটু ও ভালো লাগে না।ওনি একটু অসুস্থ হলে মনে হয় যেনো কেউ আমার কলিজা টা ছিড়ে ফেলছে।ওনি হাসলে আমার মনও হেসে ওঠে। প্রতিদিন নিয়ম করে আমাকে রাতে পড়ান ওনি।আমার প্রতি ওনার এতো যত্ন, এতো খেয়াল রাখা সব কিছুই যেনো ওনার প্রতি আমাকে বড্ড টানে।ওনি সামনে থাকলে মনে হয় ওনি হলেই হবে আর কিছু চাই না আমার এই ঠুনকো জীবনে।আমি হয়তো আসতে আসতে ওনাকে ভালোবেসে ফেলেছি। হ্যা আমি ওনাকে ভালোবাসি।ওনিও হয়তো আমাকে ভালোবাসেন নয়তো৷ আমার এতো যত্ন এতো খেয়াল রাখতেন না ওনি। আমার প্রতি ওনার মুগ্ধতর চাহনিই বলে দেয় যে ওনিও আমাকে ভালোবাসেন।তাই আজ সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি ওনাকে ওনার প্রতি আমার মনে জন্ম হওয়া প্রণয়ের কথা ওনাকে বলবো।আমি বলতে চাই যে তুর্ন স্যার আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি। তারপর আকাশের দিলে তাকিয়ে দেখি সন্ধ্যা নেমেছে আকাশের বুকে। একটু পরই হয়তো ওনি চলে আসবেন।তাই আমার শাশুড়ী মায়ের দেওয়া একটা টকটকে লাল রঙের শারি পরলাম।সাজ সজ্জা দিয়ে নিজেকে একটু সজ্জিত করলাম।চুলে বেলি ফুলের মালা লাগালাম।চঞ্চল অক্ষি দ্বয়ে মোটা গাঢ় করে কাজল দিলাম। ওষ্ঠদ্বয়ে লাগালাম লিপস্টিকের প্রলেপ।তারপর নিজেকে একবার আয়নায় দেখে মুচকি হাসলাম।ঠিক তখনি রুমে কারো উপস্থিতি টের পেতেই পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি তুর্ন স্যার অবাক হয়ে মুগ্ধ নয়নে আমাকে দেখছেন। ওনার চাহনি দেখে আমি লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেললাম।তারপর ওনি আসতে আসতে আমার সামনে এসে দাড়িয়ে আমার গালে হাত রাখতেই আমি আবেশে চোখ বুঝে ফেললাম।তারপর ওনি কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,
--তুমি যে অনেক ভয়ংকর প্রণয়নী হয়ে গেছো তা কি জানো?তুমার এই কোমলটা আমার মনে বড্ড প্রলয় তৈরি করছে তা কি তুমি অনুধাবন করতে পারছো তন্দ্রা!
ওনার এই ভয়ংকর কথা গুলো আমার মনে যে প্রবল ঝড় তুলে ফেলছে তা কি ওনি বুঝতে পারছেন না!আমি কিছু না বলে ওনাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জরিয়ে ধরলাম তারপর কোনমতো কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,
--ভালোবাসি, আপনাকে খুব ভালোবাসি তুর্ন।
এই কথা শুনে ওনিও আমাকে গভীর ভাবে আগলে নিয়ে বললেন,
--আমিও তোমাকে অনেক ভালোভাসি তন্দ্রবতী।
ওনার এইটুকু কথায়ই যেনো মনে হলো দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় সুখ আমার কাছে এসে ধরা দিলো। মনে মনে জীবনে প্রথমবার অর্পিতা মা কে ধন্যবাদ জানালাম। কারন ওনিই ভুল করে আমার জীবন এই মানুষ টার সাথে জুড়িয়ে দিয়েছেন।
সমাপ্ত~~
আরো পড়ুন: