ভয়ংকর_প্রতিশোধ
Afrin_Tarin
-সন্ধ্যা ছয়টা বেজে বিশ কিংবা ত্রিশ মিনিট তখন মিলির ছোট ভাইয়ের কলে আমার ঘুম ভাঙে।
ওপাশ থেকে আমাকে বললো কাজল আপু, আপু কি তোমাদের বাসায় আছে?
আমি মিহানকে না জানিয়ে দিলে ও আমার মন কেন জানি মানছে না। মিহান ওপাশ থেকে বলতে লাগলো আসলে বিকাল চারটা দিকে আপু তো আম্মুকে বলে গেছিলো তোমাদের বাসায় যাচ্ছে কিছু নোট আনতে। হয়তো আসতে একটু দেরি হবে বলে গেছিলো।কিন্তু আপু তোমাদের বাসায় না গেলে আম্মুকে মিথ্যে বলে কোথায় গেলো?
-আচ্ছা কাজল আপু আম্মুকে বলি গিয়ে, রাখছি।
-মিহান মিলির খোঁজ পেলে আমাকে জানিও।
মিলির জন্য কেমন জানি চিন্তা হচ্ছে, কোথায় গেলো আমাকে তো কিছু জানালো ও না।
-হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকেই মিলির মেসেজ দেখতে পেলাম,ঘুমাচ্ছিলাম তাই কখন যে মিলি মেসেজ দিয়েছে আলাপ ও পাইনি।
-কাজল আমি খুব বিপদে আছি , তোর সাথে খুব জরুরি কথা আছে। তোদের বাসায় আমি যেতে পারবো না, তুই ভার্সিটির সামনের ক্যাফে চলে আয়,আমি ও সেখানে আসছি। দেরি করিস না দোস্ত।
-মানে কিসের বিপদের কথা বলছে মিলি। চিন্তা আরো বেশি বেড়ে গেলো। মিলির কিছু হলো না তো? মিলি তো আমাকে কল করতে পারতো, আজই ঘুমাতে হলো আমার। নিজের ওপর খুব রাগ হচ্ছে।
__ হ্যালো মিহান,মিলির খোঁজ পেয়েছো? মিহান?
মিহান বলতে যেও কথা বলতে পারছে না, মিহানের কি হলো? মিলির কিছু হলো না তো?
-আপুর এক্সিডেন্ট হয়েছে, আপু আর নেই।
আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। মিলি বিপদে আছে, তাহলে ও কাল কেন আমাকে কিছু বললো না যখন এক সাথে ভার্সিটি থেকে আসলাম? আমার মাথা ঘুরপাক খাচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে না, হয়তো প্রিয় মানুষের শোক এরকম-ই।
___ মিলির সাথে পরিচয় আমার সেই কলেজ লাইফ থেকে। খুব মেদাবী ছাত্রী মিলি, মিলির থেকে সব সময় পড়াশোনা হেল্প পেতাম।তাই ওকে আরো বেশি ভালো লাগতো। আর এখন কিছু দিন পর আমাদের ফাইনাল ইয়ার পরীক্ষা। এই ছয় বছরে একবার ও মনে হয়নি মিলি আমার শুধু কলেজ পরিচিত একজন বান্ধবী। ওর মাঝে আমি বোনের মতো একজনকে অনুভব করতে পেরেছি। আমাদের সম্পর্কটা খুবই আপন ছিলো।রোজই মিলি আমাদের বাসায় আসতো, আবার আমি ও ওদের বাসায় যেতাম। আঙ্কেল - আন্টি ও খুব ভালো মানুষ ছিলেন, মিলির মতো আমাকে ও তাদের মেয়ের মতো আদর করতেন। একদিন গল্প করার মাঝে আঙ্কেল বলেই তো ওঠলেন আমার দুটো মেয়ে। আমরা তো সবাই অবাক। আমার চোখের পানি চলে আসছিলো তাদের কাছ থেকে এতো ভালোবাসা পেয়ে। মিলি খুব শান্ত স্বভাবের মেয়ে। বেশি বারাবাড়িতে ও নেই আবার মাতামাতিতে ও নেই। প্রেম-ভালোবাসা তো দূরের কথা, কোনো ছেলে ফ্রেন্ড ও নেই ওর। আর আমাকে কোনো ছেলেদের সাথে কথাই বলতে দিতো না। জানিনা কেন ও প্রেম ভালোবাসা বিশ্বাসই করতো না।
ইদানীং মিলিকে খুব টেনশনে থাকতে দেখতাম, কিছু জিজ্ঞাসা করলে বলতো আরে কিছু দিন পর পরীক্ষা তাই একটু এরকম দেখাচ্ছে হয়তো। আবার দেখতাম মিলি আমার কথা ঘুরিয়ে নিতো। তবে আগের মতো এখন আর মিলি আমাদের বাসায় আসে না। পরীক্ষার চিন্তা হয়তো তাই।
__রাত নয়টা মিলিদের বাসায় আমি, চারপাশে শুধু চিৎকারের আওয়াজ। আন্টি মিলির এক্সিডেন্টের কথা শুনেই সেন্স লেস হয়ে পরে আছে। এতোক্ষণে চারপাশের সবারই আসা শেষ। কতো মানুষ কতো রকম কথা বলছে। কেউ বলছে খুব ভালো মেয়ে ছিলো। কেউবা বলছে আহারে কালকেই তো দেখছিলাম মেয়েটাকে।
- আমি কারো কথা কানে নিতে পারছিলাম না, সবাইকে বলতে ইচ্ছে করছে কি বলছেন কি আপনারা? মিলি বেঁচে আছে। কিন্তু আমার গলা দিয়ে কোনো কথা আসছে না। এক পা দু পা করে মিলির কাছে গেলাম, কেউ একজন মিলির শরীর থেকে সাদা কাপড়টা মুখ থেকে সরিয়ে দিলো। মুখ টা থেকে চেনার উপায় নেই, এটা যে মিলি। দু ফোটো পানি যেন মিলি মুখে পড়লো। আমি শুনতে পাচ্ছি মিলি আমাকে বলছে, কেন আসলি না তখন, এখন কেন এসেছিস? আমার জীবনহীন দেহটাকে দেখতে?
__ আমি যে কখন সেন্সলেস হয়ে পরে গেছি, কিছুই জানি না। রাত দুটো।মিলি আমাকে বলছে কাজল আমি মরতে চাইনি ওরা আমাকে মেরে ফেলেছে। তুই ওদের খুঁজে বের করবি। আবিষ্কার করতে পারলাম আমি মিলির রুমে, এই রুমে মিলি আর আমি কতো যে ঘুমিয়েছি তার হিসেব নেই। আমি প্রতিটা মূহুর্ত মিলিকে অনুভব করতে পারছি। মনে হচ্ছে মিলি আমার সাথেই আছে, তাহলে আমি মিলিকে দেখতে পারছি না কেন? মিলি কোথায়?
---- কান্নার আওয়াজ বেসে আসছে আমার কানে। এতোক্ষনে হুস ফিরলো আমার। পাশের রুমে যেতে দেখলাম আমার মা, আন্টিকে সামলাচ্ছেন। আঙ্কেল বিরবির করে কি যেন বলছে। মিহান কে দেখতে পাচ্ছি না। কোথায় ও? কেউ কেউ বলছে লাস বেশি ক্ষন এভাবে রাখতে নেই,এতে কষ্ট পায়।
- মিলির কাছে যেতেই, মিহান বলতে লাগলো তোমার বাসায় যেতেই আপুর এরকম হয়েছে তুমি আপুর কাছে আসবা না। সেই মূহুর্তে আমি আর কিছুই ভাবতে পারছি না । আমিই কি মিলির মৃত্যুর জন্য দায়ী?
-মিহান খুব কান্না করছে। মিলিকে ফিরে আসার জন্য বার বার বলছে।
পুলিশ লাশ নিয়ে যেতে চাইলে ও, আঙ্কেল দেন নি।
___ভোর ছয়টায় মিলির জানাজা শেষ হলো। আমি আর পারছি না এই সব নিতে। শেষ মূহুর্তে মিলির লাশের খাট ধরে চিৎকার করে কান্না করছি।মিলিকে আমার থেকে কাউকে নিতে দিচ্ছি না। অনেকে আমাকে জোড়াজুড়ি করে মিলি নিয়ে চলছে শেষ গন্তব্যে। আমি এই মূহুর্ত কিছু বিশ্বাস করতে পারছি না। মিলি চলে যাচ্ছে, আমার ও যেন নিশ্বাস শেষ হয়ে আসছে। আবার ও সেন্সলেস হয়ে পরে গেলাম। এবার নিজেকে সোফাতে আবিষ্কার করলাম।।
___ এভাবে কেটে গেলো তিন তিনটা দিন। এই তিন দিনে কতোবার যে সেন্স হারিয়ে ছিলাম। তার হিসাব নেই। খাওয়া - দাওয়া সব কিছুই যেন ভুলেই গেছি।
-অসুস্থ থাকার কারণে মিলিদের বাসায় একবার ও যাওয়া হয় নি। আজকে যাবো সিদ্ধান্ত নিলাম। আঙ্কেল নাকি আসছিলো একবার আমাকে দেখতে। এক মেয়ে হারিয়েছে, অন্য মেয়েকে আর হারাতে চান না বলে কেঁদে গেছেন।
___শরীর টা খুবই দুবর্ল তাই ভাইয়া যেতে দিচ্ছে না। ভাইয়াকে অনেক বার বুঝাতে গিয়েও ব্যার্থ হয়েছি। বিকালে ভাইয়ার অনুপস্থিতিতে আমি মিলিদের বাসায় যাই। আন্টি আঙ্কেলের খুবই বাজে অবস্থা হয়েছে। আন্টি আমাকে দেখেই জরিয়ে ধরে চিৎকার করে ওঠলেন। আমি আন্টিকে কি বলে সান্ত্বনা দিবো, তার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। কিছুক্ষন থেকে বাসায় চলে আসলাম। মিলির রুমে যেতে ইচ্ছে করলে ও যেতে পারিনি, এই সাহস টুকু পেলাম না।তাই বায়াস চলে আসলাম।
__ আজ মিলি আমাদের কাছে নেই একমাস, এই কয়দিন বহুবার মিলিকে দুসপ্নে দেখেছি।
আর সাতদিন পর ফাইনাল পরীক্ষা। অনেক গুলো নোট নেই আমার কাছে। মিলির রুমে গেলেই হয়তো পেয়ে যাবো নোট গুলো। কারন মিলি খুব গুছালো একটা মেয়ে। পুরোনো জিনিস গুলো ও খুব যত্নে রেখে দেয়।
___ আন্টি - আঙ্কেলের সাথে কথা বলে, তাদের পারমিশন নিয়ে মিলির রুমে যাই।এই কয়দিন আঙ্কেল মিলির রুমে কাউকে যেতে দেন নি।
__রুমে ঢুকে পরিচিত ঘ্রান এসে ভাসছে আমার নাকে।৷ অনেক খোজার পর নোট গুলো খুঁজে পেলাম না। চোখ গিয়ে আটকালো কালো রং এর একটা ডাইরির দিকে। এই ডাইরি টা আমি মিলিকে দিয়েছিলাম এভার ওর জন্মদিনের উপহার হিসেবে । দু ফুটো পানি নিচে পরলো। ডাইরি টা খুলতেই একটি শুকনো গোলাপ ফুল নিচে পরে গেলো।
অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, মিলি একটা ফুল এতো যত্ন করে রেখে দিয়েছে?
ডাইরির ভিতর কিছু একটা আছে ফুলানো দেখেই বুজলাম। একটা চিরকুট।
চিরকুট টা খুলতেই দেখলাম সুন্দর করে গুছানো কিছু লেখা।
___________ প্রিয় রজনী,
জানো রজনী, আমি কখন তোমার প্রেমে পরেছি? যেদিন তুমি কাজলের সাথে প্রথম আমাদের বাসায় আসো।এতো দিন তোমাকে বলতে পারিনি ভয়ে। কিন্তু ভালোবাসার মধ্যে তো কোনো ভয় নেই তাই না। তুমিও যে আমাকে এতো তাড়াতাড়ি গ্রহন করে নিবে, আমি কখনোই ভাবিনি। খুব তাড়াতাড়ি আমি তোমাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসবো আমার বউ করে। এতো দিন তুমি কাজলকে কিছু বলো না আমাদের এই ভালোবাসার সম্পর্কের কথা। কাজলকে সারপ্রাইজ দিবো আমরা। খুব ভালোবাসি রজনী তোমাকে।
I love you.
ইতিঃ তোমার ভালোবাসার (নিলয়)
আমি চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। নিলয় ভাইয়ার তো অন্য একজনের সাথে রিলেশন ছিলো। বিয়ে ও প্রায় ঠিক আমার মামাতো বোনের সাথে গ্রামে থাকে তারা।
__কিছু পৃষ্ঠা ওলটাতেই লেখা-Thank you my love,
I love you so much Niloy.
___ডাইরিতে আর তেমন কিছু লেখা নেই, মাঝ পৃষ্টায় একটা ছবি, ছিঃ কি দেখছি আমি - মিলির আপত্তিকর একটা ছবি সাথে দুজন ছেলে, বেশ ঘোলাটে হলে ও চিনতে আমার বাকি রইলো না নিলয় ভাইয়ার বন্ধু তো ওরা।
তার পরের পেইজ এ লেখা- নিলয় তুমি আমার সাথে এরকম বিশ্বাস ঘাতকতা করতে পারলে? তোমার জন্মদিনের মিথ্যে নাটক সাজিয়ে তুমি আমাকে ছিঃ নিলয় ছিঃ!
আর তুমি আমাকে এখন এই ছবি দেখিয়ে ব্লাকমেইল করছো। এই তোমার ভালোবাসা ছিলো? আমার বিশ্বাস তুমি এভাবে শেষ করে দিলা?। কাজল তোমার বাবা-মা যদি জানে তোমার এই সুন্দর চেহারাটার ভিতরে কুৎসিত একটা মানুষ আছে তখন কি হবে? লিখা গুলো খুব ঘোলাটে, বুঝাই যাচ্ছে মিলির সমস্ত চোখের পানি এই পেইজ টাতে আঁটকিয়েছে।
আমার চোখ গুলো ঘোলাটে হয়ে গেছে। চোখের লোনো জল এই পৃষ্ঠাতে গড়িয়ে পরছে।
রাগ- ঘৃণা নিয়ে ডাইরি টা সাথে করে নিয়ে আসলাম।
__ছিঃ আমার ভাইয়া তাহলে মিলির মৃত্যুর কারন।আমার তাকে ভাইয়া বলতে ঘৃণা করছে। রাতে এক ফোটা ঘুম আসেনি, সকালে ডাইনিং এ বসে এককাপ কফি নিয়ে বসেছি।
মা নিলয় ভাইয়ার জন্য খাবার রেডি করছে,
নিলয়ঃ মা আমি খাবো না এখন আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে অফিসে।
আমার মা ছেলে ভক্ত, ভাইয়ার কথা না শুনে ভাইয়াকে খাবার খাইয়ে দিতে লাগলো।খুব মনোযোগ সহকারে দেখছি, মা- ছেলের খুনসুটি।
নিলয়ঃ কিরে কাজলা এমন করে কি দেখছোস, মা আমাকে খাইয়ে দিচ্ছে বলে তোর হিংসে হচ্ছে? নাকি লোভ লাগছে?
___হয়তো এটাই তোমার শেষ খাবার মায়ের হাতে, তুমি একাই খেয়ে নেও। আমার এতে লোভ লাগছে না।।
___মা আর ভাইয়া ড্যাপ ড্যাপ করে তাকিয়ে আছে, মা আমাকে কিছু একটা বলবে, তার আগেই ভাইয়া বললো, মা - আমি আসছি তোমরা খেয়ে নিও। আজ আসতে আমার দেরি হবে।
____ মনে মনে বলতে লাগলাম দেরি না ভাইয়া, আর কখনোই বাসায় আসবা না তুমি।
____সন্ধায় খবর আসলো নিলয় থানাতে আছে। সাথে তার তিন বন্ধু। পুলিশ হেফাজতে মিলি হত্যা মামলায়। ধর্ষণকারিদের কখনোই ক্ষমা নেই। তিনদিন রিমান্ডে দেওয়া হয়েছে। তারপর ফাঁসি নিশ্চিত।
- সব প্রমান সহ উপস্থিত করেছেন কাজল।
(সমাপ্ত)
( ভুল- ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন? গল্পটা কেমন হয়েছে জানাবেন? আশা করি ভালো লাগবে। গল্পটা পুরোটাই কাল্পনিক, কেউ বাস্তবের সাথে মিলাবেন না। ধন্যবাদ সবাইকে )