বাংলা সুন্দর ছোট গল্প ২০২৩ গল্পের নাম আদুরী

 
বাংলা সুন্দর ছোট গল্প ২০২৩ গল্পের নাম আদুরী

- বিয়ের এক সপ্তাহ পর জানতে পারলাম আমি আমার স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী। এ-কদিন যাকে বড় জা ভেবে এসেছি তিনি আসলে আমার সতীন। 

গোপন একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে আমার সামনে থাকা মহিলার মুখ পানে তাকালাম। ওনি বেশ চমকানো নয়নে তাকিয়ে আছেন। কণ্ঠস্বর টেনে প্রশ্ন করলেন, আপনি তাকে কিছু বলেননি? স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও বিয়ে করেছে আবার আপনার কাছ থেকে প্রথম বিয়ের খবর লুকিয়েছে তার তো শা'স্তি পাবার কথা।

আমি স্মিথ হাসলাম। গ্রামের পরিবেশে বড় হয়েছি। পড়াশোনা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত। ছোট বেলা আমার জন্মের পর মাকে হারিয়েছি। বাবা মাস খানেক পর বিয়ে করে আমাকে রেখে যান নানার বাড়িতে। নানার বেশ প্রিয় ছিলাম সেজন্য নানা নাম রেখেছিল আদুরী। বাবাকে সেদিনের পর আমি দেখিনি। কেমন দেখতে জানি না। তবে অনেকবার আমায় তিনি দেখতে চেয়েছিলেন কিন্তু আমি দেখা দেয়নি। যে লোক এক মাসের বাচ্চাকে দূরে সরিয়ে রাখে সে কখনোই বাবা হতে পারে না। বাবা হয় নির্ভরতা, রোদের উত্তপ্ত তাপের একটুখানি ছায়া। কিন্তু আমার বাবা তেমন ছিলেন না সেজন্য আমিও তাকে বাবা মানি না। আমি যখন উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হই তখনি হারিয়ে ফেলি আমার নানাজানকে। মামীর চোখের বালি ছিলাম। মামা বহু কষ্টে আমাকে ফাইন্যাল পরীক্ষা দিতে দেন। পরীক্ষার একমাস পর হুট করেই জানতে পারলাম আমার বিয়ে। ছেলে শহরে থাকে। বেশ এটুকুই আমাকে বলা হয়েছিল। ইচ্ছে না থাকা সত্বেও বিয়ের আসরে সেদিন বসতে হয়। 

- তারপর কী হলো?

মহিলার চোখে তখন এক রাশ কৌতূহল। আমি ম্লান হেসে বললাম, একটু পানি দিবেন?

মহিলাটি পানির গ্লাস হাতে এগিয়ে দিল। এক নিঃশ্বাসে সবটুকু পানি শেষ করে পুনরায় বলতে লাগলাম, শশুর বাড়িতে পা রাখলাম কিন্তু লোকজন দেখতে পেলাম না। বিয়ে বাড়ির কোনো চিহ্ন খোঁজে না পেয়ে চাতক পাখির মতো স্বামীর মুখের দিকে তাকালাম কিন্তু সে আমার তাকানোকে পাত্তা না দিয়ে ভিতরের রুমে চলে গেল। শশুর,শাশুড়ি,ননদ এবং সুন্দরী একজন রমণীকে দেখতে পেলাম। রমণীর কথা জিজ্ঞাসা করাতে জানতে পারলাম সে আমার বড় জা। যেহেতু আমি তাদের সম্বন্ধে কিচ্ছুটি জানতাম না তাই বিশ্বাস করে নিলাম মেয়েটি আমার জা।

- আপনার সতীনের ভাব ভঙ্গি পরিবর্তন হয়নি? কারণ কোনো নারীই তার স্বামীর ভাগ কাউকে দিতে চায় না। 

কণ্ঠে তাচ্ছিল্য ভাব ফুটিয়ে বললাম, সে সত্যিই তার স্বামীর ভাগ আমাকে দেয়নি।

- আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না প্লিজ পরিষ্কার করে বলুন।

বিয়ের রাতে আমাকে এবং আমার স্বামীকে এক রুমে দেওয়া হয়। সেদিন আমার স্বামী জানালার এক কোণে দাঁড়িয়ে থেকে শান্ত কণ্ঠে আমায় বলল, আদুরী তুমি বেশ ক্লান্ত ঘুমিয়ে পর। আমি আসছি। দরজা বন্ধ করে শুয়ে পর।

আমি সেদিন বেশ অবাক হলাম। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলিনি। ভেবেছিলাম সে হয়তো আমায় সময় দিচ্ছে। নতুন পরিবেশ নতুন মানুষ তাই মানিয়ে নেওয়ার জন্যে সময় দিচ্ছে। পরেরদিন ভোর সকালে সে রুমে আসে। বিছানার এক কোণে শুয়ে আমায় বলে, বাড়িতে বলবে না আমি আজ এ ঘরে ছিলাম না।

বোকার মত মেনে নেই তার কথা। নাস্তার টেবিলে বসা মাত্রই শাশুড়ি মা এসে ফিসফিসিয়ে বললেন, বউমা আমি কিন্তু তাড়াতাড়ি আমার বাসায় নতুন অতিথি চাই। তুমি কিন্তু আমার আশা পূরণ করবে।

শাশুড়ি মায়ের কথা কানে আসতেই দেখলাম শান্তা আপা মানে আমার সতীনের চোখের কোনে চিকচিক করছে অশ্রুবিন্দু। তবুও সন্দেহ হয়নি। ভেবেছিলাম তাদের বাচ্চা হচ্ছে না বলেই হয়তো আপার মনে কষ্ট।

সময় অতিবাহিত হলো। প্রতি রাতে আমার স্বামী আমাকে ঘরে একা রেখে কোথাও চলে যেতেন। সাতদিনের মাথায় চিন্তা করলাম কোথায় যায় সে, আমি জানতে চাই। সেজন্য যখন সে রুম থেকে বিদায় হয় আমিও তার পিছু নেই। ছাদের দরজায় পা রাখতেই চোখজোড়া চড়ক গাছের মত থমকে যায়। শান্তা আপা ওর বুকে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। ভাঙা গলায় সে বলে, আর কতদিন আদুরীকে লুকিয়ে যাব ঘটনা। আমার ভালো লাগছে না শান্তা। ভীষন কষ্ট হয়। মেয়েটাকে আমরা ঠকাচ্ছি। তাছাড়া তুমি ছাড়া অন্য কোনো নারীকে আমি স্পর্শ করতে পারব না।

- কিছু করার নেই নাঈম। আমি তোমার বিবাহিত বউ হওয়া সত্ত্বেও বড় ভাইয়ের বউয়ের অভিনয় পালন করছি। তুমি আদুরীকে নিয়ে একটু ভাবো। ডক্টর বলেছে আমি মা হতে পারব না এখন যদি আদুরীর মাধ্যমে এই সংসারে বংশধর আসে তাতে ক্ষতি কি। পরে নাহয় মেয়েটাকে সব বলো।

- আমরা তো সন্তান দত্তক নিতে পারতাম শান্তা।

- মা কখনো মানবেন না। ওনি তোমার রক্তের বংশধর চান। 

নাঈম চোখে মুখে বিরক্ত ফুটিয়ে পিছনে তাকিয়ে আমাকে দেখেই চমকে গেল। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে কণ্ঠে ম্লান হয়ে বললাম, বলি কেন আমাকে হতে হলো বলবেন? ছোট থেকেই তো অন্যর দয়া নিয়ে বেঁচে আছি ভেবেছিলাম বিয়ের পর জীবনে সুখ আসবে কিন্তু সুখ তো আমার ভাগ্যতে নেই। আফসোস কী জানেন আমার নাম আদুরী না হয়ে কষ্ট রাখা উচিৎ ছিল।

মহিলাটি উৎসুখ মুখখানি নিয়ে আবার প্রশ্ন করল, আপনাকে তারা কিছু বলেনি আর? থানা পুলিশ মামলা কিছু করেননি?

- থানা পুলিশ করার মত আমার কেউ ছিল না। আমি বাড়ি থেকে চলে আসার পথে আমার শশুর বাড়ির সবাই আটকানোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু আমি থাকিনি। যে মানুষটার আশায় পাড়ি জমিয়েছিলাম সেই মানুষটা যদি আমার না হয় তাহলে সেখানে থেকে কি লাভ।

- আপনার মামা মামী ওনাদের কাছে যাননি?

- পৃথিবীতে আপন বলতে আমার নানাজান ছিল। তিনি চলে যাবার পর থেকে আমি একলা। তাই মামা মামীদের সমস্যা বাড়াতে যাইনি। এখন আপাতত ভালো আছি ভীষন ভালো। আদুরীরা একা থাকতে ভালো থাকে। নিঃসঙ্গ পথিক হয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দিতে চাই। আপনি আমার কাহিনীটুকু আজ পত্রিকায় ছাপাবেন না।

- কিন্তু কেন?

- একটা দিন আমি একা থাকতে চাই। আপনি আগামীকাল আমার ঘটনা পত্রিকায় প্রকাশ করবেন তবে শেষের লাইনে লিখবেন,
মানুষের সবচেয়ে ভয়ানক অভাব হলো একা আর প্রেমহীন হয়ে যাওয়া।
— (মাদার তেরেসা)

##সমাপ্ত

আদুরী
®ফারজানা মুমু
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন